প্রদীপ চক্রবর্তী

দেবারতি মিত্রের কবিতারা : তোলপাড় সমুদ্র আর ধূ ধূ সমুদ্রকে নিয়ে …

 
এক .

এক একটা ভোরের স্বপ্নে জলে বুদ্বুদ ভাঙতে ভাঙতে গান নিজেই উজানে বৈঠা ভাসিয়ে দেয় | এই গান কেমন যেন ভূতে পাওয়া। সে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গাইছে,

ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায় ?
কে তোমায় নিয়ে যায়
দূর অজানায়,বলোনা আমায়
ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায় ?

আমি নই সে বিরহী আমার
কাউকে বলার কিছু নেই
তবু যেন কি বেদনা জমে উঠে হৃদয়ে
মনে হয় আমার কেউ কেন নেই ঐ অলকায়
ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায় ?

আমি ঘুমের ঘোরে দেখি, এক দেবী মূর্তি। চুল খুলে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক চোখে অপার সন্তান স্নেহ, অন্য চোখে অদ্ভুত বিরহ | এক অন্তহীন অপেক্ষা | আমি অবাক হই , মানবী মূর্তিতে এই দেবীকে তো আমি দেখেছি | দেখেছি তাঁর সন্তান স্নেহ , অপার বাৎসল্য | উনিশশো সাতানব্বই সাল | এক গ্রীষ্মের দুপুর | অভুক্ত আমি | একটি নতুন পত্রিকা বের করার জন্য হন্যে হয়ে কবিতা খুঁজছি | পত্রিকার নাম দেব , কুরুক্ষেত্র | ঠিক করেছি | কিন্তু যার বা যে কবি দম্পতির বাড়িতে যাবো বলে ঠিক করেছি , এবং দুঃসাহসের ডানায় ভর করে গেছি , তারা কি কবিতা দেবেন ? আমার দূর মফস্বলের ঠিকানা শিল্পনগর দুর্গাপুর | গেছি গড়িয়ার যোগিয়া এপার্টমেন্টে | এখানে থাকেন বাংলা কবিতার দুই শ্রেষ্ঠ স্তম্ভ , মণীন্দ্র গুপ্ত এবং দেবারতি মিত্র | এই কবি দম্পতির কাছে যাওয়া যদি কবিতা পাই ! মনে আছে , সেই দাবদাহে ভরা গ্রীষ্মের দুপুরে অজ্ঞাতকুলশীল এই যুবকটিকে না চিনেই , প্রথমে বসিয়ে তার পর , পেল্লায় সাইজের এক প্লেট মিষ্টি নিয়ে দেবারতি মিত্র আমাকে বলেছিলেন , তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে কিছুই খাও নি | আগে খাও | আমার মৃদু আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে , তিনি সামনে বসে বলছেন খাও খাও , বাচ্চা ছেলে , এটুকু মিষ্টি খেতে পারবে
না ? এরপরে তিনি যা করলেন , তা অভাবিত | সাটডাউন নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ | ঘরে ফ্যান চলছে না | আমি দর দর করে ঘামছি | তিনি একটি তালপাখা এনে আমাকে হাওয়া করতে লাগলেন | আমি অবাক | তারচেয়েও বড়ো
কথা , আজন্ম স্নেহের কাঙাল আমি | আমার ভেতর এক অজানিত ব্যথা এসে ভর করেছে | চোখ ভিজে যাচ্ছে এই অপত্য স্নেহে | দেবারতি বুঝলেন | আমার অস্বস্তি | তিনি মাথায় মৃদু হাত বুলিয়ে বললেন , কি হলো , খাও | সামনের সেই লম্বা চেয়ারে রাজকীয় ভঙ্গিমায় বসে আছেন , এক রহস্যময় পুরুষ | ঠোঁটে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি | এবং আরও বড়ো চমকপ্রদ ঘটনা যে , আমার কাছ থেকে আমাদের এখনো অপ্রকাশিত পত্রিকার জন্য লেখা চাওয়ার আর্জি শুনে , মণীন্দ্র বাবু তার নতুন লেখা কবিতা তিনি হাতে হাতে কপি করে দিলেন , দেবারতি দি বললেন , এখন আমার কাছে লেখা নেই | হলেই দেব | আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন | পরে দেবারতি দি কবিতা দিয়েছিলেন | আমি অভিভূত এবং বাকরুদ্ধ | কারণ ? আমাকে একজন বিদগ্ধ পন্ডিত ব্যক্তিত্ব বলেছিলেন বা পূর্বেই সাবধান করে দিয়েছিলেন , যাচ্ছ যাও কিন্তু লেখা পাবে না | অতি সহজে মণীন্দ্র বাবুরা বা দেবারতি দি’রা লেখা দেন না | তিনি নামি মানুষ | তার পত্রিকার নামডাক আছে | আছে একরাশ অহং | তবুও তিনি এই কবি দম্পতির কাছে লেখা পান নি | তিনি বারণ করেছিলেন যেতে , তবুও আমি জেদের বসেই গিয়েছিলাম | নাই বা পেলাম লেখা | অন্তত বাংলা কবিতার এই কিংবদন্তি দম্পতিকে একটু চোখের দেখা দেখতে পাবো | এটা সেই সময় যখন ঘরে ঘরে বি এস এন এলের টেলিফোন নেই | মোবাইল এসেছে কিন্তু সবার নেই | যোগাযোগের মাধ্যম , ডাকযোগে | একটা লেখা পাঠালে কোথাও জানতেই পারতাম না সে লেখা ছাপা হলো কিনা | আর জন্মসূত্রে কলকাতার হলেও , বাবার কর্মসূত্রে দুর্গাপুরেই আমার শৈশব কৈশোর যৌবন এবং এই মাঝবয়সে এসে দাঁড়িয়েছি | ঘন ঘন কলকাতা যাবার মতো পয়সা নেই | চাকরি হয় নি তখনো | টিউশন আর স্থানীয় সংবাদপত্রে ফিচার লিখে কিছু
হাত খরচ | সে এক সময় যখন দূরদর্শনের অবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী | তখনো রঙিন টিভির চেয়ে ঘরে ঘরে সাদা কালো সাটার দেওয়া ঢাউস টিভি | সেই অজ্ঞাতকুলশীল লাজুক আমি
তখন , মণীন্দ্র গুপ্তের শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু পড়ে অবাক | এরকমও কবিতা লেখা যায় ? লেখেন যে তিনি নিশ্চই অতিমানবিক | আর দেবারতি মিত্রের , ভূতেরা ও খুকি , বইটি পড়ে কতদিন রাত আমার তোলপাড় হয়ে গেছে | পরে যখন শুনি , মণীন্দ্র বাবু ও দেবারতি মিত্র কবি দম্পতি | তখন বিস্ময়ের ঘোর আরও বাড়ে | মূর্খ যেমন না জেনেই অনেক অত্যাশ্চর্য কাজ করে , আমিও তেমনি না বুঝেই যে কাজটি
করেছিলাম , তারজন্য আমার নিজের পিঠ নিজেই পরবর্তীকালে চাপড়াই | কারণ আমার সমস্ত জীবনের অভিমুখ যে বদলে যাবে এই অকস্মাৎ ঘটনায় , সেদিন ছিল তার শুরুয়াত |
তো আমি পেয়েছিলাম | হয়তো কল্পিত গতজন্মের কিছু পুণ্য সঞ্চিত ছিল , তাই এই অযাচিত দাক্ষিণ্য | এরপর এই কবি দম্পতির বাড়ি আমার কাছে অবাধ হয়ে উঠেছিল | বা ভরকেন্দ্র | মনে পড়ে , কত দিন রাত ফোনে ফোনে জ্বালিয়েছি মণীন্দ্র বাবু ও দেবারতি দি কে | কিন্তু তারা হাসি মুখে আমার আবদার মেটাতেন | মণীন্দ্র বাবু আমাদের পত্রিকার প্রচ্ছদ করেন | পরবর্তী কালে ওনার ছবি ও লেখা নিয়ে কুরুক্ষেত্রে ক্রোড়পত্র করি | ওনার মাধ্যমেই আলাপ হয় , রঞ্জিত দা কবি রঞ্জিত সিংহ , শম্ভু রক্ষিত , দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে | যাইহোক , দেবারতি মিত্রের কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে এসব কথা এসে যাবেই | কারণ আগে জেনে নিতে হবে দেবারতি মিত্রের কবিতার উৎস কি ?
আমি আজ যে বইগুলোর কিছু লেখা নিয়ে
কিছু বলবো , সেই বইগুলো হলো ,
” ও ও ও ও ,”এবং ” অগাধ বিরহ |” সম্ভবত দেবারতি মিত্রের এগুলো শেষ কবিতার
বই | তার পরে কিছু হলেও আমার জানা নেই | বইগুলো প্রকাশ করেছে , দেবভাষা ও চিত্রক পাবলিকেশন | পার্থপ্রিয় বসু , চিত্রক পত্রিকা ও প্রকাশনীর কর্ণধার | এই কবি দম্পতির অত্যন্ত কাছের | বলতে দ্বিধা
নেই , পার্থ দা র মতো ভূগোলবিদ , অধ্যাপক , কবি গদ্যকার ঔপন্যাসিক আমারও খুবই কাছের মানুষ | এ রম আমৃত্যু কয়েকজন কাজের মানুষরাই ছিলেন এই কবি দম্পতির আশা ভরসা |

মণীন্দ্রবাবু যখন দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন দেবারতি মিত্রকে , তখনও ওনার প্রথম পক্ষের স্ত্রী বেঁচে ছিলেন | এবং মণীন্দ্র বাবুর একমাত্র পুত্র এই প্রথম পক্ষের |

পঞ্চাশের কবিদের কাছে একটি স্বপ্ন ও সম্ভাবনার নাম দেবারতি | অপূর্ব সুন্দরী | উত্তর কলকাতার মামা বাড়িতে কেটেছে ছোটবেলা | সেই সূত্রে ডাফ স্কুলে পড়াশুনো শুরু | পরে দক্ষিণ কলকাতার বাবা – মায়ের কাছে থাকার সময় ইউনাইটেড মিশনারি , যোগমায়া দেবী কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেন | ভারতের স্বাধীনতার আগে ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে তার জন্ম | এহেন উচ্চশিক্ষিত , অতি সম্পন্ন একটি পরিবারের মেয়ে হয়ে , কেন তিনি বাউন্ডুলে মণীন্দ্র বাবুর স্ত্রী হয়েছিলেন , একসময় তা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায় , বাংলা কবিতার নেপথ্য ইতিহাস | সে সব গল্প আমি শুনেছি এই কবি দম্পতির অত্যন্ত কাছের মানুষ কবি রঞ্জিত সিংহের কাছে | সে সব কথা না বললেও চলে | তবে এটা ঠিক , মণীন্দ্র বাবুর কেবল নিছক সহধর্মিনী ছিলেন না দেবারতি মিত্র | ছিলেন একাধারে ফ্রেন্ড ফিলোজফার এন্ড গাইড | মণীন্দ্র বাবুর আশ্রয় ও একান্ত ভরসা স্থল | উভয়েই উভয়ের কবিতা নিয়ে মূল্যবান গদ্য লিখেছেন | সেখানে কিন্তু দাম্পত্য নয় , একজন জহুরি আলোচকের চোখ দিয়ে নিখুঁত পর্যালোচনা আমরা পেয়েছি |
দেবারতি মিত্র ছিলেন একান্তই ঘরোয়া মানুষ | ঘরোয়া কিন্তু অদৃশ্য এক ব্যক্তিত্বের আবরণে ঢাকা | কাছের বলেই সুদূরপরাহত এক দূরত্ব রচনা তিনি করতে পেরেছিলেন | কেবল কবিতার মধ্যে দিয়েই সেই আবরণ ভাঙতেন তিনি |

তার কবিতার জগতে ফিরে ফিরে এসেছে , এক মায়াবী মা ও মেয়ের বা বহুস্তরীয় মেয়েদের
কথা | এ প্রসঙ্গে সব চে কাছের মানুষটির বয়ানে শোনা যাক | দেবারতি মিত্রের কবিতা নিয়ে লিখতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত কি বলছেন , দেখি আমরা ….

সাধারণত মায়েরা ছেলেসন্তান পছন্দ করে , মেয়ে নয় — অন্তত যৌবনের প্রথম দিক তো
নয়ই | দেবারতির কিন্তু ইচ্ছে ছিল
মেয়েসন্তানের | একটা মেয়ে নয় , যমজ মেয়ে | মেয়েদের মধ্যে সে হয়তো একজন মনের সঙ্গী ও বন্ধু আশা করতো | ছেলেরা গর্ভ থেকে বেরুলেও , তার কাছে বিদেশী , ভিনদেশী , অন্য যোনির | মেয়ের জন্য টান ও ছেলের জন্যে এই আতঙ্কের পিছনে হয়তো তার মনের গড়ন , হয়তো তার কোনো ক্লিষ্ট অভিজ্ঞতা কাজ করেছে | হয়তো মনের গ্রন্থিতে ঢুকে থাকা তার মা আর বোনের প্রতি টান এবং বাবা ও প্রেমিকের প্রতি বিরূপতা এভাবেও প্রকাশ পেয়েছে | কিন্তু হায় , যে মেয়ের মন এইরকম আগ্রহী আর শরীর ভিনাস অব উইলেনডর্ফের মতো উর্বরতার প্রতিমূর্তি সত্যিকারের জীবনটা তাকে নিঃসন্তান কাটাতে হলো |

হ্যাঁ , মণীন্দ্র গুপ্ত ও দেবারতি মিত্রের কোনও সন্তান ছিল না |

কিন্তু স্নেহপ্রবণ এই মানুষীটির স্নেহের উৎসমুখ খোলা ছিল তার বোন কবি দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের প্রতি এবং তার মায়ের প্রতি | দেবাঞ্জলির তিনি নিছক দিদি ছিলেন না | ছিলেন অভিভাবিকা , স্নেহময়ী মা এবং বন্ধু | সন্তান স্নেহে লালন পালন করেছিলেন তার এই ছোট বোনটিকে | এরফলে অকালপ্রয়াত দেবাঞ্জলির শোক তাকে দিশেহারা করে দিয়েছিলো | এক অসহনীয় কষ্ট , শোক ও মনোবেদনা তার কবিতায় ফুটে উঠেছে | তার কবিতায় কল্পনা বিশুদ্ধ ও অভাবনীয় সৌন্দর্যে নিবিড় | আত্মসত্তা এমনভাবে মিশে যায় কল্পনার ভেতর , সামগ্রিক অনস্তিত্বের মুখোমুখি চলে আসে অস্তিত্বের পরতে পরতে | দ্বান্দ্বিকতার ভেতর অভেদ এত স্বাভাবিক ভাবে আসে যে সীমারেখা বলে কিছু থাকে না |

এরফলে প্রথমে অজাত সন্তানকে নিয়ে আশা ও রোমাঞ্চ | পরে সন্তানসম বোনের মৃত্যুর কষ্ট বোবা আর্তনাদের মতো ভলকে ভলকে তুলেছে দিকদিশাহারা রক্তাক্ত শোকের সন্তাপ | পরে সময়ের স্রোতে বদলে যায় তার অত্যাশ্চর্য মনোভূমি | কল্পিত কন্যা ও পুত্রদের নিয়ে লেখা কবিতাগুলো অদ্ভুত ভালোবাসা ও ব্যথার স্পর্শে দ্বিমুখী | যেহেতু কল্পনার সন্তান , সেহেতু তারা বারবার ফিরে আসে জন্ম মৃত্যুর মায়া কাটিয়ে | ইহজগত , পরজগৎ , বাস্তব ও তার ছায়া , জীবন ও তার বিচ্যুতি , যুগ্ম ভাবের প্রতিরূপতা , কখনো রূপক , কখনো উপমায় বিস্তৃত হয়েছে | কাল্পনিক অনস্তিত্ব ক্রমশ অস্তিত্ব হয়ে নাড়ীছেঁড়া আদরে মাখামাখি হয় | রক্তের বন্ধনের উর্দ্ধে , জড় ও জীবের দূরত্ব ক্রমশ হারিয়ে যায় তার কবিতায় | যেখানে জড় , নির্জীব নয় জীবন্ত | জড় বলে কিছুই নেই | জীবের বিকশিত বিন্যাস হলো এই জড় | দেবারতি মিত্রের কল্পনা ও কবিত্বশক্তি প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতের মধ্যবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে একটা ছোট্ট জগৎ তৈরী
করে | আপনজনের মৃত্যুর পর , আত্মার অবস্থান জানার জন্য তিনি তীব্র ভাবে পড়তে থাকেন , মরণের পারে , স্বামী অভেদানন্দজী ‘ র , লাইফ বিয়ন্ড ডেথ | এই স্পৃহা ক্রমশ অবসেশনে পৌঁছয় | জীবন থেকে ঘুম ক্রমশ ছুটি নিতে থাকে | বাড়তে থাকে নানা রকম রোগ ব্যাধি | দেবাঞ্জলির মৃত্যুর পর , তার নামে বছরে বছরে পুরস্কার ঘোষণা | প্রথম বছর পেয়েছিলেন কবি শক্তি সেনগুপ্ত | যা আমার অভিজ্ঞতার মধ্যেই পড়ে |

তো যা বলছিলাম জন্ম মৃত্যু প্রাণ নিয়ে দেবারতি মিত্রের নিজস্ব একটি জগৎ তৈরী হয়েছিল | এবং অভূতপূর্ব কল্পনাশক্তির সঙ্গে জীবনের সুদূরপ্রসারী পটভূমিকা | আমার আলোচ্য বইয়ে যাবার আগে আমি এমন কয়েকটি কবিতার প্রসঙ্গ তুলে ধরবো , যেখানে রমণীত্বের সঙ্গে মিশে আছে আবেশ ও আচ্ছন্নতা , অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার গহনতম প্রদেশে নেমে নিজের মর্মের মধ্যে টেনে এনেছেন সজীব ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে বস্তু ও প্রাণকে মৃত্যুর নিকষে ঘষে সচেতন ও অচেতন সমস্ত বস্তুর ওপরে মমতা ও নশ্বরতার দূরপনেয় ব্যঞ্জনা ও চিত্রকল্প | এতক্ষণ যা বললাম , তার প্রমাণে কিছু কবিতার অংশ তুলে ধরছি —-

এক.

দু’সপ্তাহ পরে কুয়াশা নদীর ধারে
কলসি ভরতে গিয়ে দেখি
রয়না ফলের মতো টকটকে ন্যাকড়া নিয়ে
গিন্নিশকুনেরা খেলছে —
‘আমার বোনের জামা — আমার বোনের লাল জামা
কাউকে দেব না আমি কিছুতে দেব না –‘
রাবণের চিতার মতন জোরে চিৎকার করি।

দুই .

চাঁদের গায়ে বিরাট বাড়ি — কটকটে আলো
কিন্তু হাওয়া নেই বলে সব ঘরগুলোই অন্ধকার |
তার পর মুদ্রাস্ফীতি —
ধানের খেতে একরাশ নোনাধরা টাকার স্তূপ
কোথায় উধাও লক্ষ্মীপেঁচা ও কুসুমকড়ি |

তিন .

কলাবু নামের মেয়ে গাছলতাপাতাফুল
হাঁসের ছানার মতো জ্যান্ত ভাবত ,
ভোরের স্বপ্ন হেন নটেশাক কুটতে কুটতে
শাকের কান্না শুনে কেঁদে ফেলত |
সে কি ধরে রাখতে পারল নিজের প্রাণকে
তার স্পন্দন হিল্লোল?

চার .

এক – একদিন শেষরাত্তিরে চুল আঁচড়ে আঁচড়ে
শুকতারা ছুঁড়ে দাও আমার বিছানায় ,
তোমার বুকের দুধে আমার চোখমুখ ভিজে
যায়

পাঁচ .

বাংলা অনার্সের ছাত্রী আমার মেয়ে
সন্ধেবেলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ে —
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল ,
শরীর তরু , তার পাঁচটি ডাল |

মেয়ে গির্জের চূড়োয় আকাশের ঝলক ধরা বাজকাঠি — হতভম্ব !
তার চোখের কাজল লম্বা হতে হতে কালো মেঘ , অঝোর বর্ষণ ,
নিরালা ছাদের টবে ঘোরনচাঁপা গাছে থৈ থৈ জল |

ছয় .

কুমকুমের টিপ ফুটে ওঠে অন্ধকারে
ফুটে ওঠে তার মুখ , রোগা ফরসা অপলক |
লাল বিন্দু দেখলেই ভাবি সূর্য |
‘ সূর্য নিয়ে অত আদিখ্যেতা করো না তো দিদি ,
তার চেয়ে চলো পাহাড়ের নীচে জুনিপারবন
ঘুঘুপাখি – রঙের অজস্র পাথর , দ্যাখো দ্যাখো
হরিণটা ঠিক তোমার মেয়ের মতো চেয়ে আছে ,
ওই ছুটে গেল গাছের ফাঁকে রোদ্দুর থেকে ছায়ায় — ‘
হৃদয়রেখার মতো ফাটল , অগাধ ঝরনা ,
আশেপাশে মেঘের কাজলগাঢ় টান |
মেয়ের মতো লাজুক হরিণ হয় ,
আর ছোট বোন কি মেয়ে হয় না ?

শেষের কবিতাটির নাম , সাদা কালো গান | কবিতাংশের নাম এখানে যতটা গুরুত্বপূর্ণ , তারচে আরও বিবেচনার বিষয় যেটা সেটা হলো দেবারতি মিত্রের কবি মনন | আগেই বলেছি ঘরোয়া পরিবেশে , নিজের আত্মিক সম্পর্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে কবির কাল্পনিক ও বস্তু জগতের বিস্তার | তিনি চাইতেন কন্যা সন্তান | ব্যক্তিগত জীবনে সেই পার্থিব ইচ্ছে পূরণ না হলেও , নিজের বোন ও পৃথিবীর নানা স্তরীয় মেয়েরা এমনকি পুত্রেরা তার কাল্পনিক উপাখ্যানে উঠে এসেছে | তিনি তাদের নিজেই নামকরণ
করতেন | যেমন তুন্নু , খুকু ,বালিহাঁসিনী , বিন্নু , বাংলা অর্নাসের ছাত্রীটিও তার পরম মমতায় গড়া মেয়ে | কখনো হারামণি হয়ে মৃত ও অসময়ে খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটি ফিরে ফিরে এসেছে একটি কাঁচপোকা , প্রজাপতি কিংবা মাটির পুতুল হয়ে | কখনো মা বালিহাঁসিনী , ছেলে মানুষ | এ যেন আদিম অবিকল্প সম্পর্ক | কখনো পুরুষ রমণীর ভেদাভেদহীন , গভীর স্তরে প্রাণ বা মর্মে লিঙ্গভেদহীন | দেবারতি মিত্রের কবিতায় সম্পর্ক বড়ো আশ্চর্যের | সেখানে পাখি , পশু , মানুষ , পাথর , নিসর্গ কখনো পুরুষ কখনো নারী কখনো লিঙ্গভেদহীন প্রাণী হিসেবে সম্পর্কে একাকার হয়ে যায় | প্রাণের চেয়েও প্রিয় বোনের মৃত্যু তাকে এমনভাবে নাড়িয়েছিলো , আজীবন সেই নিষ্ঠুর দহন ও যন্ত্রণা একা একা ভোগ করেছেন | দুটি কবিতা তুলে ধরছি পর পর | যেখানে একদিকে মেয়েরা মৃত হলেই পাখি হয়ে যায় | তার পার্থিব মৃত্যুর উর্ধে বন্ধনমুক্ত এক অন্তহীন কাল এবং অসীম জগতে কিংবা শরতসায়াহ্নের মেঘে বা অপরাহ্ন রৌদ্রে তাদের ভেসে যাওয়া | গাছের পাতা শিশিরে ভিজে উঠবার আগেই যেন তারা উড়ে যায় | কবি আকুল তাদের বাসস্থানের সন্ধানে |

সাত .

আগে ভাবতুম ছেলেমানুষ , আনাড়ি ,…
কিন্তু কার্যকালে দেখি জীবনকে মহাকাশ দিয়ে গুণ করে , তা থেকে মৃত্যু বিয়োগ করে
তার সঙ্গে স্বপ্ন যোগ করে
তাকে প্রকৃতি দিয়ে ভাগ করে
কতই না কঠিন সরল অঙ্ক সে মিলিয়েছে |
বিধুর হাসি মুখে নিয়ে আমাকে বলত —
দিদি , তুমি আমার আগামী দিনগুলো নিয়ে
বড্ড বেশি ভাবো |
সামনে কিছুই নেই ,
আমার ভবিষ্যৎ আমি , আমার ভবিষ্যৎ
আমিই

আট .

ভয়ঙ্কর বৃষ্টি এল , ঘর খুঁজে পেলাম না ,
তাই ফিরছি |
আমি বলি — তোকে যে তেমন করে নাচ গান ছবি আঁকা লেখাপড়া
কিচ্ছু শেখাতে পারিনি খুকু ,
তাই মনের দুঃখে পাখি হয়ে গেলি !
আয় , একটু শস্যদানা খা , একটু জল খা ,
এখানেই থেকে যা |
আমাকে কি রাখতে পারবে চিরকাল ?
এই বলে সকাল অন্ধকার করে , বাতাসে ভর
ফুড়ুৎ উড়ে যায় মেয়ে |
ঝড় বাজ বিদ্যুৎ তার দেয়াল জানলা দরজা ,
কিন্তু মাটিতে নামতে গেলেই মুশকিল —
এস্কেলেটরের মতোই পৃথিবী সরে সরে যাচ্ছে —
কোথায় বসবে ও ?
কোথায় একটা ঘর খুঁজে দেব ওকে ?

দুই .

দেবারতি মিত্রের মানসগঠনের যেদিক তা আমাকে অভিভূত করে | আগেই বলেছি পারিবারিক পরিবেশে স্বচ্ছন্দ কবি মায়া এবং মমতায় গহনে বিস্তৃত | এর একটি দিক বাৎসল্য এবং প্রগাঢ় জীবনবোধ | এতো ব্যাপ্ত কাল্পনিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি যে ভাবলে অবাক লাগে | নিজের সন্তানসম বোনের প্রতি ভালোবাসা এবং কন্যা সন্তানের প্রতি নিবিড় স্নেহ তার কবিতার আধার | সেই কল্পনার আশ্রয় ব্যক্তিজীবন থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যদের প্রতি | কবি মণীন্দ্র গুপ্ত , তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা একজন মানুষ | দেবারতির প্রসঙ্গে এক জায়গায় তিনি বলছেন —- অনেকদিন হল মাংসাশী দেবারতি মাংস খাওয়া প্রায় ছেড়েছে , মাছ খেতেও তার প্রাণ চায় না — মাছ কিনতে গিয়ে সে দ্যাখে জ্যান্ত মাছগুলো কিভাবে বাঁচার জন্য পালাতে চায় | নিয়মিত সে কুটনো কোটে | আমাকে দুয়েক বার বলেছে : ‘ নটে শাক , কলমি শাক কী টাটকা সবুজ , লকলক করে যেন জ্যান্ত | বঁটির মুখে ধরলে থর থর করে কাঁপে — আমি ওদের কান্না শুনতে পাই ‘| ব্যাপারটা বোধ হয় সবটাই কবির আদিখ্যেতা নয় |

ভাবুন পাঠক একবার ! যে নারী , জড় ও জীবের মধ্যে কোনও পার্থক্য অবলোকন করেন না , প্রতিটি প্রাণী জীব জন্তু গাছ উদ্ভিদ শস্যকণার প্রতি যার অসীম স্নেহ , তিনিই যখন একে একে কাছের মানুষদের দূরে সরে যেতে দেখেছেন এবং ক্রমনিঃসঙ্গতা যাকে একাকী থেকে আরও একাকী করেছে , তিনি যখন তার শেষ প্রিয়জন স্বামী মণীন্দ্র গুপ্তকে ছেড়ে চলে যেতে দেখলেন , তখন সেই অসম্ভব শোক তাকে ভেতরে বাইরে নিঃশেষিত করে দিলো | কবি দেবারতি মিত্র বলেন , কবিতা লিখতে তার খুব কষ্ট হয় | এই কথার উৎসে রয়েছে তার অনেক কবিতাই মানুষের জন্য তার বিভিন্ন কষ্ট থেকে
উৎসারিত | যে কোনও মানুষের দুঃখে তিনি সকাতর হন তীব্র ভাবে |

এর প্রমাণ আমরা পাই , তার শেষের দিকে দুটি কবিতার বইয়ে | একটি দেবভাষা থেকে প্রকাশিত ‘ ও ও ও ও ‘, অন্যটি চিত্রক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত , অগাধ বিরহ |
মাত্র বারোটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত বই , ‘ ও ও ও ও ‘ | এই বই অবাক ও বিস্মিত করে আমাদের | কারণ দুঃখবোধজাত কল্পনা ও অনুভব কত নিগূঢ় সৌন্দর্য ও অভিনব হয়ে উঠতে পারে যে পাঠকের মনে এই কবিতাগুলো কেবল জীবন্ত হয়ে ওঠে তাই নয় , এক অসীম পারাপার সৃষ্টি করে আশ্চর্য শিশুর ইমেজে | যেখানে জন্ম মৃত্যু স্মৃতি সত্তা শৈশব অলৌকিক কল্পলোক মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় | এরফলে মৃতের মৃত্যু নেই | জীবিত ও মৃত দ্বিতীয়টি প্রথমটির ছায়া বা প্রতিবিম্ব নয় , দুটিই সমান এবং একান্ত সত্য | এর ফলে একাকী দেবারতির অতি প্রিয়জন কবি সম্পাদক গদ্যকার ও ঔপন্যাসিক মণীন্দ্র গুপ্তর মৃত্যুর পর এই শিশুর জন্ম | আমরা ‘ ও ও ও ও ‘ , কবিতার বইয়ে দেখছি সেই শিশুকে | প্রিয় মানুষ ও একান্ত আপন মণীন্দ্র গুপ্তর মৃত্যুর পর , তিনি এক মুহূর্তের জন্য তার চলে যাবার শোক ও বিরহ ভুলতে পারেন নি | যারা দেবারতি মিত্রের সঙ্গে পরিচিত এবং যারা তার গদ্য পড়েছেন , তারা সবাই জানেন , স্বামী মণীন্দ্র গুপ্তকে বহু দিন ধরেই তিনি সন্তান তুল্য মনে করতেন | মণীন্দ্র দা ও মনে করতেন , দেবারতি তার একান্ত নির্ভর অভিভাবিকা | এই দম্পতির অন্যতম কাছের বন্ধু কবি প্রাবন্ধিক
রঞ্জিত সিংহ , আমাদের প্রিয় রঞ্জিত দা নানান আড্ডায় আমাকে বলেছেন , যে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হবার পর , মণীন্দ্র বাবু প্রায় ভবঘুরে হয়ে উঠেছিলেন | থাকা খাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না | এই ভবঘুরে জীবনে তখন একমাত্র আশার আলো দেবারতি | তিনি মণীন্দ্র বাবুর তৎকালীন বাসস্থানে গিয়ে প্রতিদিন নানা রকম রান্না করে রেখে দিয়ে আসতেন একটি পুরোনো ফ্রিজে | এবং নিয়ম করে ধমক ধামক , বুঝিয়ে শুনিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো আবদার অত্যাচার সহ্য করে মণীন্দ্র বাবু যেন ঠিক সময় খাওয়া দাওয়া করেন , সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখতেন | এমনকি আমিও দেখেছি এই প্রবীণ দম্পতির বাড়িতে গিয়ে ঠিকসময় ঠিক ঔষধটি যাতে মণীন্দ্র বাবু খান এবং তার খাওয়া দাওয়া জীবন যাপনে এক মুহূর্তের জন্যও যাতে ফাঁকি না পরে , সেদিকে সজাগ দৃষ্টি | এরকম স্নেহ ও সেবা করতে গিয়ে তিনি নিজে যে নানারকম রোগের শিকার তা বুঝতে চাইতেন
না |

যাইহোক যেটা বলছিলাম , এই কবিতার বইয়ে , মণীন্দ্র দা র প্রয়াণের পর শিশুটির গোটা শরীরী ইমেজ , তার খেলাধুলো , তার দুস্টুমি , ইশারায় কথা বোঝানো , এমনকি শিশুটির নামকরণ করলেন ‘ মনা ‘| সেই মনার অবাক হওয়া , তার বায়না সবকিছুই অসামান্য ভাবে এসে গেলো তার কবিতায় | এ যেন সত্যিকারের মায়ের বেদনাগাঁথা | এখানে অপূর্ব কল্পনা কিভাবে বাস্তব হয়ে উঠেছে , তা বোঝানোর জন্য কয়েকটি কবিতার পংক্তি এই বই থেকে তুলে ধরছি |

‘ ঝিনুকের মতো সপ্তমীর চাঁদ ওকে দুধ খাওয়াবার জন্যে মুখিয়ে আছে | ‘মনা ‘ মাথা ব্যথা করলে উঁ উঁ করে , / পেট কামড়ালে কড়ে আঙুল নাড়ে ‘|

সমুদ্রের তীরে মনা বালিতে গড়াগড়ি দিয়ে / খেলা করছে | / বুড়ো আঙুলের মতো ছোট্ট , কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং , / মুখের ভেতরটা গোলাপি |

‘ সারা আকাশে চাঁদমালার মতো / তেইশ চব্বিশটা সূর্য | / আমি আলো ফেলে খুঁজছি আমার বাচ্চাকে , / একমাত্র সন্তানকে |’
‘ অনন্তের বোন অমানিশার কোলে কাঁখে / মনা ঘুরে বেড়াচ্ছে | / ওর মতো এত দীর্ঘতম মৃত্যু তো / অন্য কোনো বাচ্চা সহ্য করতে পারে না , / তাই অমানিশা ওকে ছাড়ছে না ‘|

পাঠকের দুচোখ জলে ভিজে যাবে , শোক কত তীব্র হলে এই হাহাকার শেষ বিন্দু মনের রক্ত নিয়ে উঠে আসে |

যে নারী তার স্বামীকে সন্তান স্নেহে দেখে এসেছেন , সেই অতি প্রিয় মানুষ চলে গেলে তারই একটি কাল্পনিক শিশু রূপ প্রতিষ্ঠা করে , এই রকম নিঃসঙ্গ হাহাকারের জগৎ নিবেদন করতে পারেন কবিতায় —

‘ আমি কি চেয়ার , টেবিল , টেলিভিশন , আলমারি , / রেডিয়ো , বইপত্রকে দুধ খাওয়াবো ? / নিকুচি করেছে পাখিপক্ষী , জীবজন্তু , গাছপালার |/ ওরা কি কেউ মনার সমান !’

এমনকি শেষ পর্যন্ত চির রহস্যে ঢাকা মৃত্যুর পরপার নিয়ে যে অপূর্ব কল্পনার ছবি তিনি এঁকেছেন , বাংলা কবিতার পৃথিবীতে তা
বিরল …

পরলোককে আমি দেখেছি —
সে বিনয় নম্রতা ও সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলে |
অনন্ত আলো আর বিরতিহীন অন্ধকারের স্তম্ভ
দপদপ করছে এমনই পরলোক |

তিন .

ভেবে অবাক হই , কবিতাকেন্দ্রিক উপঢৌকন এবং প্রাপ্তির সমাহার নিয়ে সারাবছর ধরে
” কবিতা “কে সাইনবোর্ড ক’রে যে উৎসব চলে সারা পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম শহর মফস্বল অলি গলি রাজপথে , উপলক্ষের ছুতোয় , সেই প্রবাহ গিয়ে জমা হয় কল্লোলিনী তিলোত্তমার আদি গঙ্গায় | কারণ কবিতা নিয়ে রং তামাশা লেগেই থাকে বাঙালির জীবনে | কিন্তু জনারণ্যের ভিড়ে একজন মানুষ বলা চলে সাধারণ মানুষ কখন কেন কবিতা লেখে সেই গভীর ভাবনার কাছে গেলে যে উত্তর পাওয়া যায় , যে জীবন নশ্বর ও বহুস্তরীয় রঙে রূপে আনন্দে বেদনায় ঘাত প্রত্যাঘাতে নির্জন ও একাকী সেই আমি ‘ কে নানারূপে তুলে ধরা | জীবনী নয় , জীবনের মহার্ঘ্য অনুভূতি ও উপলব্ধিগুলোকে | সব সময় যে মহার্ঘ্য তা তো নয় | বেরঙিন জীবনের হতাশ্বাস ও অকল্পনীয় ব্যর্থতাগুলোও | কবিতা অনেক প্রকার | তার প্রকাশ ভঙ্গিও বিবিধ | কিন্তু যিনি তার মন ও মননের মধ্যে দিয়ে তার প্রসারিত কাল্পনিক ও বোধের উপাখ্যান তুলে ধরেন , তার কাছে বিবিধ ভিড় ও পুরস্কার তুচ্ছ | এমনকি পাঠকপ্রীতি অর্জন করবে কিনা সেই সংশয়ও ঝুটো | তিনি লেখেন এ সবের উর্ধে দাঁড়িয়ে | বেশ কিছু পুরস্কারে পুরস্কৃত কবি দেবারতি মিত্রের কাছে , এই পুরস্কার একান্তই গৌণ ছিল | চিরকাল নামী পত্রিকায় তার কবিতা যত্নের সঙ্গে স্থান পেয়েছে | অন্যদিকে তার জীবনের একটা বড়ো অংশে জুড়ে থাকা কবি মণীন্দ্র গুপ্ত , চিরকালই লিটল ম্যাগে লেখালিখি করেছেন | বিলম্বিত সময়ে বেশ কিছু পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন , কিন্তু উভয়ের কাছে লেখার প্রাধান্য ছাড়া সব কিছুই গৌণ বলেই মনে
হয়েছে | কোনও রকম ছোটাছুটিতে তাঁরা অনভ্যস্ত ছিলেন | ছিলেন বলেই , ব্যক্তিজীবনে তাদের ঘরের দরজা দরাজ বুকে হাট করে খোলা থাকতো সবার জন্য | সেখানে কোনও অহমিকা কোনোদিনও প্রবেশ করতে পারে নি |
যাইহোক , শেষের দিকে দেবারতি মিত্র অসহায় একাকিত্বের নিদারুন দুঃখে কাতর ছিলেন | নানান রোগে শরীর ভেঙে পড়েছে | যখন মণীন্দ্র বাবু বেঁচেছিলেন তখন প্রতিদিন ছিল ওদের যোগীয়া এপার্টমেন্টে নানান কবি সাহিত্যিক সম্পাদক বন্ধুদের ভিড় | কিন্তু মণীন্দ্র বাবু চলে যাবার পর , সেই ভিড় ক্রমশ কমতে থাকে এবং এক সময় শেষের দিকে প্রায় কেউই খোঁজ খবর রাখতেন না দেবারতি মিত্রের | এ নিয়ে ছিল তার বুক ভরা অভিমান | দু একজন বাদ দিয়ে কেউই আসতেন না |

শেষের দিকে আস্তে আস্তে লেখার প্রতি আকর্ষণ হারাতে থাকেন তিনি | তবুও যা লিখেছেন সেই সমস্ত লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয় , চিত্রক প্রকাশনী থেকে , অগাধ বিরহ নামক কবিতার বইটি | আড়াই ফর্মার এই বইতে মোট বত্রিশটি কবিতা আছে | এবং কবিতাগুলি যেন মর্মন্তুদ এক একাকী জীবনের শেষ প্রার্থনায় আমাদের অশ্রুসজল করে দেয় |
বেশি উদাহরণ নয় | পাঠক বইটি সংগ্রহ করে পড়ে নেবেন |
আমি এই বইয়ের কেবল প্রথম ও শেষ লেখা দুটি পর পর তুলে ধরছি —

শোকের আগুনে
অশ্রুজলে সেদ্ধ হতে হতে
একমুঠো চাল আমার জীবন
আজ হাঁড়িভরতি ভাত
উথলে পড়ছে , উপচে উঠছে |

এই অন্ন কেউ খাবে ?
এই অন্ন কাকে দেব ?
এসো , বোসো ,
তোমাকেই আস্তেব্যস্তে বেড়ে দিই —
তুমি খাও , খেয়ে তৃপ্ত হও |

( এই অন্নভোগ )

যার হাত ধরতে যাই , সে ছাড়িয়ে নেয় ,
নাকি ছেড়ে যায় আপনাআপনি |
চুপিসাড়ে আনন্দকুমার ও ব্যথাদেবী কখন যে
আসে , যায় টের পাই না |
মৃত্যু যেন কোলের ছেলের মতো
আমাকে সজাগ করে রাখে ,
সবটুকু মনোযোগ দাবি করে |
কেবল দুহাতে মুখ ফেরায় তার দিকে ,
বলে দেখ , দেখ , আমাকেই দেখ |

হায় রে , কিশোরী যেরকম
সিগারেট খাবার তেষ্টা এড়াতে পারে না
তেমনই আমার এই মৃত্যুকে জীবন সঁপে
দেওয়া |

( সিগারেট )

সেই বিদুষী অভিজাত নারী , যিনি যোগমায়া দেবী কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং যথার্থ বোধের ও চিন্তনের দিক থেকে চির আধুনিক | সেই হরিণীর মতো যার মন পঞ্চাশ দশকে , বাক বৈদগ্ধ্যে কলেজ উৎসব কফিঘরে কৌশলী নিপুণতায় সঙ্গীর মনে স্বপ্ন এঁকে দিত | সেই রমণী যিনি বলেছেন , ভালোবাসা পেলে কান্না পায় , কিন্তু মনে কীরকম আলো প’ড়ে নেচে উঠতো জলের আয়না | পৃথিবীপারের দেশ থেকে যিনি খুঁজে আনতেন ধৌত নীলিমায় ঈষদচ্ছ দ্যুতিময় প্রত্যেকটি নিখুঁত অনুভূতির দানা , শব্দে শব্দে | যিনি ভালোবাসতেন জল , প্রিয় প্রতীক স্নান ও বৃষ্টি | কবিতার মধ্যে তৈরী করেছিলেন অপূর্ব স্নান বৈচিত্র | স্নানঘরে স্নান , বৃষ্টিতে ঝরনায় ছাদে জমা জলে স্নান | লিখতেন প্রেম ও শৃঙ্গারের কবিতা | যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন , আদরের কবিতা | গভীরসঞ্চারী চোখের বিদ্যুতে কখনো বা মত্ত হয়ে টাল খেয়েছে , উথলে উঠেছে আপন জোয়ারে কত পুরুষ কবি , যিনি ছিলেন অনেকের কাছে নেশা ফুল কিন্তু অনেকেই তার ব্যক্তিত্বে দূর থেকে পুজো করে গেছে , এই উদাসীনা তরল অনলময় মায়াকে , সেই তিনি জীবনের অন্তিমে এসে তীব্র একাকিত্বের দহনে বিক্ষত |

সেই চির বিরহী কবি যখন বলেন ,

‘ এক কাপ চা দাও ‘ তুমি বললে
কতদিন পরে আজ কতদিন পরে |
অনন্তের পার থেকে তোমার গলার স্বর
তীক্ষ্ণ নীল সূর্যরশ্মি নয় , নয় এ তো
শ্রাবণসন্ধ্যার একটানা ঝিল্লিরব |

বেলফুল গাছের গোড়ায়
একটু একটু করে জল ঢালবার মতো
তোমার গলার স্বর
আমার আত্মাকে শান্তি দিল ,
লোকান্তরে নিয়ে গেল আজ |

(তোমার গলার স্বর )

আর তাই আপন প্রিয় প্রয়াত মানুষটি হয়ে যায় মনা আবার কখনো কেউ নেই সেই নির্জন জীবনে রান্নার ভাত তুলে দেন আপন মনে প্রিয় মানুষটির কল্পনায় | তিনি আজ তার অপেক্ষায় তীব্র ব্যাকুল | কেবল এক কাপ চা দেবার জন্য কি আকুল আততি |

যিনি একসময় হাজারো এক বুভুক্ষু সাধারণ মানুষ ও কবির জন্য সর্বদাই অন্নপূর্ণা হয়ে পাত পেতেছেন , তারই দুয়ারে আজ কেউ নেই | একেই বলে সময়ের নির্মম নিষ্ঠুরতা | এখানে কবিতার উৎকর্ষতা বা কবিতার মান কিরকম তা বলার ধৃষ্টতা কারোর নেই | কিন্তু একজন যার লেখার পথে , প্রথমাবধিই রমণীত্বের সঙ্গে মিশিয়েছেন প্রবলতা , মিষ্ট আবেশ আচ্ছন্ন বিধুরতা , প্রেম ও তীব্র স্নেহ সেই মানুষীই এই অন্তিমে যা লিখেছেন , সেটি তার কাব্যিক সিদ্ধি বা যাত্রাপথের চূড়ান্ত পরিণামের কবিতা |

একজন কবি যে সাধিকা , তিনি যে কাব্য সাধনায় তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষিত করেন তার সততা , অন্ধকার অকূলের জলধারা ঠেলে নিয়ে আসছে ওপারের আলো | এবং তারপর সেই নিশ্চিত মৃত্যু যেন দুই কবি মিলে গেলেন গন্ধর্বদম্পতির মতো সাদা মেঘের দুখানি ক্ষীণ রেখায় | কল্পনায় দেখি |

আজ আর কবির জীবনে টানাপোড়েন , তীব্র বেদনার অসহ ভার নেই | নেই প্রতীক্ষা | নেই প্রিয় বিয়োগের ব্যথা | কারণ নির্ভার মৃত্যু পরবর্তী এই অনন্ত জীবন যা অনিঃশেষিত , গন্ধরাজ ফুলের মতো খোলামেলা শান্ত , কী অক্ষয় জন্মমৃত্যুরহিত নির্জন —

মৃত্যুর পরে আজ আমি পল্লবিত হয়ে উঠছি ,
ফুটে উঠছি গন্ধরাজ ফুল |
মৃত্যুর পরে তো এমনই হয় ,
ভারী পাথরটা সরে গেছে ,
ফনফন করে বেড়ে উঠছে গাছ |
আমার যত কিছু ঢাকা , চাপা , অন্তর্নিহিত
সবই আজ খোলা আকাশের তলায়
দ্বিধাহীন , ব্যথাহীন |

এইরকম স্বতঃস্ফূর্ত দিন চেয়েছি তো আমি ,
চেয়েছিলে তুমি |
অলিম্পিক দৌড়ে ফার্স্ট হওয়া বিস্ময়বালিকার মতো
আজ নির্ভার ঝরঝরে আমার প্রাণ |
আমাকে অভিনন্দন জানায় মাটি ,
বৃষ্টি , রোদ্দুর , নক্ষত্রেরা হেসে বলে
সব ভালো যার শেষ ভালো |

খোলামেলা নিরাকাশে আজ আমি
গন্ধরাজ ফুল হয়ে ফুটে উঠছি |

( আজ গন্ধরাজ ফুল )

আর আমি কথা বাড়াবো না | এখন যেন এক নৈঃশব্দের জগৎ উড়ে যাচ্ছে জীবনের খোপে খোপে | স্মৃতিরা যেন মেঘ শাওনের বৃষ্টি | আমাকে উজাড় করে , বৃষ্টি মাখা বাঁকা রোদ্দুর খেলছে শেষ বেলায় | একটা অনুতাপ আটকে আছে | কারণ , এগারোই জানুয়ারি , দুহাজার চব্বিশ | দেবারতি মিত্র আমাদের ফেলে চলে যান | আমার নিজের মনে মনে যে অনুতাপ , তা হলো ,আমিও পারিনি ওনার সঙ্গে শেষ কয়েকবছর যোগাযোগ রাখতে | শুধু দুহাজার তেইশের বইমেলার শেষ দিন ওনাকে ফোন করেছিলাম | কিছু অস্ফুট শব্দ তাড়িত করে আমাকে | কই আর আসো না তো ?
কিছু বলতে পারি নি অপরাধীর মতো | নিজেকে কথা দিয়েছিলাম এবার নিশ্চয় যাবো যাবো যাবো , বইমেলার মধ্যে | কিন্তু বুঝিনি সময় আমাদের মতোই কথা রাখে না | কারণ বইমেলার শুরুর কয়েকদিন আগেই তাঁর চলে যাওয়া | আর তো দেখা হবে না | যুগ যুগান্তর চলে যাবে | আমিও চলে যাবো | কিন্তু সেই অনুতাপ পাথরের দরজার মতো বন্ধ করে দিল গহ্বরের মুখ | যার থেকে এজীবনে মুক্তি নেই …!

Facebook Comments

Related posts

Leave a Comment